ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ পরিবার নিয়ে রাশিয়ার মস্কোয় পৌঁছেছেন। রোববার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সংস্থা ক্রেমলিনের সূত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আসাদ ও তার পরিবারকে রাশিয়া আশ্রয় দিয়েছে। ইন্টারফ্যাক্স নিউজ এজেন্সি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে বলেছে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ মস্কোতে পৌঁছেছেন। রাশিয়া তাদের (তাকে এবং তার পরিবারকে) মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে।
এর আগে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক দখল করে ‘মুক্ত’ ঘোষণা করেন বিদ্রোহীরা। রোববার তারা দামেস্ক দখল করে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের ঘোষণা দিয়েছেন। আলজাজিরার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘সিরিয়ান আরব প্রজাতন্ত্রে সংঘাতে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের সঙ্গে আলোচনার পর আসাদ প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ এবং দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেন।’
রাশিয়া আসাদের প্রস্থানের বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেয়নি বলেও জানিয়েছে মস্কো।
রাশিয়া আসাদের কট্টর মিত্র ছিল এবং গৃহযুদ্ধের সময় তাকে সমর্থন করার জন্য ২০১৫ সালে হস্তক্ষেপও করেছিল। কিন্তু রাশিয়ার সামরিক আয়োজন ইউক্রেনের যুদ্ধে কেন্দ্রীভূত হওয়ায়, সিরিয়ায় পরিস্থিতি প্রভাবিত করার ক্ষমতা অনেকটাই সীমিত হয়ে এসেছিল।
রাশিয়ার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের ডেপুটি চেয়ারম্যান কনস্টান্টিন কোসাচিভ বলেছেন, মস্কো সিরিয়ার জনগণকে সমর্থন করতে ইচ্ছুক, কিন্তু সম্ভবত অতীতের মতো সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়বে না।
তিনি বলেন, ‘সিরিয়ার জনগণের যদি আমাদের সমর্থন প্রয়োজন হয় তবে তা দেওয়া হবে৷’ তবে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সিরিয়ানদের নিজেদেরই মোকাবিলা করতে হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে
সিরিয়ার বিদ্রোহী জোট জানিয়েছে, তারা একটি অন্তর্বর্তী শাসকগোষ্ঠীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য কাজ করছে।
জোটটি জানিয়েছে, ‘মহান সিরিয়ান বিপ্লব আসাদ সরকারকে উৎখাত করার সংগ্রামের পর্যায় থেকে সিরিয়াকে একত্রে গড়ে তোলার সংগ্রামে উন্নীত হয়েছে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ কবলিত সিরিয়াকে আবার সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া এড়াতে এমন ঘোষণা বিদ্রোহী নেতাদের পরিপক্কতার উদাহরণ।
সিরিয়ার সশস্ত্র বিরোধী কমান্ড জানিয়েছে, স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা থেকে দামেস্কে কারফিউ জারি হবে। স্থানীয় সময় সোমবার সকাল ৫টা পর্যন্ত এই কারফিউ বলবৎ থাকবে।
মিলিটারি অপারেশনস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন টেলিগ্রামে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে, তবে কারফিউ এর কারণ জানানো হয়নি।
নানা দেশের প্রতিক্রিয়া
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ এক্স-এ একটি পোস্টে আসাদের পতনকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘বর্বর রাষ্ট্রের পতন হয়েছে শেষ পর্যন্ত। আমি সিরিয়ার জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাদের সাহসিকতার জন্য, তাদের ধৈর্যের জন্য৷ অনিশ্চয়তার এই মুহূর্তে, আমি তাদের শান্তি, স্বাধীনতা এবং ঐক্যের জন্য আমার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে ফ্রান্স।’
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস এক্স-এ দেওয়া এক বার্তায় বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা দ্রুত পুনরুদ্ধার করাই এখন গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘সিরিয়ার জনগণ ভয়াবহ দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছিল। সিরিয়ায় আসাদের শাসনের অবসান তাই সুসংবাদ।’
সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়, সকল সংখ্যালঘুদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতে সুরক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে শলৎস বলেন, ‘সকল সিরিয়ান মর্যাদা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্যে জীবনযাপন করছেন কিনা, তৃতীয় পক্ষের দূষিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব রক্ষা হচ্ছে কিনা এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করা সম্ভব হচ্ছে কিনা, সেগুলোরর ওপর নির্ভর করেই ভবিষ্যত শাসকদের বিবেচনা করা হবে।’
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিরিয়ার ঘটনাবলী নিয়ে তেহরান ‘উপযুক্ত পন্থা ও অবস্থান’ গ্রহণ করবে।
ইরান মনে করেন, সিরিয়ানদের উচিত তাদের দেশের ভবিষ্যৎ ‘ধ্বংসাত্মক, জবরদস্তিমূলক, বিদেশি হস্তক্ষেপ ছাড়াই’ নির্ধারণ করা উচিত।
আসাদ সরকারের প্রধান সমর্থকদের মধ্যে একটি ছিল ইরান।
বিদ্রোহীরা দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ইরানের দূতাবাসে হামলা চালিয়েছে। তবে ভবনটি আগেই খালি করে কূটনীতিকরা চলে গিয়েছেন বলে জানিয়েছে ইরানের গণমাধ্যম।
দামেস্কের উপকণ্ঠে মাজেহ সামরিক বিমানবন্দরের কাছে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অস্ত্রের ডিপোতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস ওয়ার মনিটর এর প্রধান রামি আবদেল রহমান ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘মাজেহ সামরিক বিমানবন্দরের কাছে সিরিয়ান সেনাবাহিনীর চতুর্থ ডিভিশনের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।’
বার্তা সংস্থা এপিও এই আক্রমণের খবর দিয়েছে।
সিরিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে হামলা নিয়ে ইসরাইল প্রায়শই মন্তব্য করে না৷ তবে তারা জানিয়েছে যে সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ইসরাইল-অধিকৃত গোলান মালভূমি বরাবর সিরিয়ার সঙ্গে জাতিসংঘ-নিয়ন্ত্রিত বাফার জোনে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সিরিয়ার বাশার আসাদের পতনকে স্বাগত জানিয়ে এটিকে একটি ‘ঐতিহাসিক দিন’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইরানের ‘অশুভ অক্ষ’ এর ‘মূল কেন্দ্র’ হিসাবে সিরিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন নেতানিয়াহু।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘হিজবুল্লাহকে আমরা যে আঘাত দিয়েছি তার সরাসরি ফলাফল’ আসাদ সরকারের পতন।
আসাদের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র লেবাননের জঙ্গি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসাবে ৬০ দিনের মধ্যে দক্ষিণ লেবানন থেকে নিজেদের সদস্যদের প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়েছে।
নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আমরা কোনো শত্রু শক্তিকে আমাদের সীমান্তে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে দেব না।’ তথ্যসূত্র: ডয়েচে ভেলে