অনিয়ম, দূর্নীতি, ব্ল্যাকমেইলসহ পাহাড়সম অভিযোগ। হয়েছেন চাকরিচ্যুতও। তবু থামেননি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে কর্মরত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। অভিযোগ আছে এই বিভাগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের “কাছের মানুষ” খ্যাত কামরুজ্জামান কোন কিছুকেই পরোয়া করেন না। তিনি যার প্রতি নাখোশ হয়েছেন, তাকেই পোহাতে হয়েছে ভোগান্তি। মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের ভয় দেখিয়ে আতঙ্ক সৃস্টির মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেডের (বিডিসিসিএল) ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক অ্যান্ড ট্রান্সমিশন) এই কামরুজ্জামান।
৬টি প্রমাণিত অভিযোগে প্রকল্প থেকে চাকরিচ্যুত কামরুজ্জামান ডাটা সেন্টারে ফিরতে ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন খোদ তার কাছের মানুষ পলককেও। প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ প্রক্রিয়া, সহকর্মীদের সাথে অসদাচরণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিরোধীপক্ষের সামিয়ানায় সরব উপস্থিতির মতো অভিযোগ এবং নানান অনিয়মের পরেও ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়েছেন কামরুজ্জামান।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের মে মাসে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) অধীনে সে সময় চলমান ‘ফোর টিয়ার জাতীয় ডেটা সেন্টার স্থাপন’ প্রকল্পে মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার (কম্পিউটার ও নেটওয়ার্ক) পদে নিয়োগ পান কামরুজ্জামান। সে সময় লিখিত পরীক্ষায় সর্বনিম্ন নম্বর পেয়ে চতুর্থ অবস্থানে ছিলেন তিনি। তবে আশ্চর্যজনকভাবে মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে চূড়ান্তভাবে শীর্ষস্থান পান কামরুজ্জামান। লিখিত পরীক্ষায় কামরুজ্জামানের চেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া ইশতিয়াক আজাদ এবং আকতারুজ্জামান মৌখিক পরীক্ষায় পান তার থেকে কম নম্বর পান। এই নিয়োগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন একজন প্রভাবশালী এপিএস, তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী পলকের সরাসরি হস্তক্ষেপে ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে সেসময়কার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, লিখিত পরীক্ষায় ৫৩ এবং ৫১ নম্বর পাওয়া যথাক্রমে ইশতিয়াক আজাদ এবং আকতারুজ্জামান মৌখিক পরীক্ষায় পান যথাক্রমে ৮ এবং ১০। আইসিটি বিভাগের একটি সূত্রের মতে, সেসময়কার প্রকল্প পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহর সরাসরি হস্তক্ষেপে লিখিত পরীক্ষায় সর্বনিম্ন নম্বর পাওয়া কামরুজ্জামানকে মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরিতে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ তথা ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত তার চাকরির মেয়াদ থাকার কথা ছিল।
অবশ্য চাকরি পেয়ে আরও ঔদ্ধত হন কামরুজ্জামান। বিসিসি সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের জনবল স্থায়ীকরণের কাজের দায়িত্ব পেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থেকে ‘ফান্ড কালেকশন’-এর প্রস্তাব দেন তিনি। এ ছাড়াও বহু আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে তার নাম জড়িত। এ কারণে পূর্বেও তাকে বদলি করা হয়েছিল।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতেন কামরুজ্জামান। নারী সহকর্মীকে অশালীন ও অপেশাদার ভাষায় হেনস্তা করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অনিয়মে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের পদবিকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করতেন তিনি। কর্মস্থলে অনুপস্থিতির কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইরেশ সারোয়ারকে তিনি হুমকি দেন। কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রকল্প পরিচালক বরাবর অভিযোগ এবং থানায় সাধারণ ডায়েরি দায়েরে বাধ্য হয়েছিলেন ইরেশসহ গার্ড ইউনুস হাওলাদার এবং মালি আন্টু প্রামাণিক।
এ ছাড়া গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কের কিছু মালামাল কৌশলে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিলেন কামরুজ্জামান। এমন অন্তত ছয়টি ভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৯ সালের মার্চে চাকরিচ্যুত করা হয় তাকে।
আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিসহ চাকরিতে পুনঃবহালের জন্য তিন দফা আবেদন করেন কামরুজ্জামান। ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কামরুজ্জামানকে চাকরিতে পুনঃবহালের তদবির করে আইসিটি বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব বরাবর সরকারি চিঠি দেন। জবাবে বিসিসির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক পার্থপ্রতিম দেব নিজ পর্যালোচনায় কামরুজ্জামানকে পুনঃবহাল করা সমীচীন হবে না বলে মত দেন।
তবে প্রকল্প থেকে বিডিসিসিএল গঠিত হলে আবারও বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন কামরুজ্জামান। জানা যায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকসহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই নেতার সবুজ সংকেতে ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক অ্যান্ড ট্রান্সমিশন) পদে আবেদন করে নিয়োগ পরীক্ষা দেন কামরুজ্জামান। বুয়েটের অধীন অনুষ্ঠিত টেকনিক্যাল পদগুলোর সেই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন কামরুজ্জামান। আইসিটি বিভাগের একটি সূত্রমতে, পুনরায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের অনুরোধে কামরুজ্জামানকে চাকরি দিতে বিডিসিসিএলের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পর্ষদকে প্রকাশ্যে চাপ দেন পলক। পলকের নির্দেশে ব্যবস্থাপক (নেটওয়ার্ক অ্যান্ড ট্রান্সমিশন), ব্যবস্থাপকসহ (ক্লাউড সিকিউরিটি) কয়েকটি কারিগরি পদে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। তবে এবার সব মানদ- পাশ কাটিয়ে কারিগরি পদের নিয়োগ পরীক্ষা বুয়েটের বদলে আইসিটি বিভাগের অধীন বিসিসিতে অনুষ্ঠিত হয়। এবারের পরীক্ষায় কামরুজ্জামানকে কৃতকার্য দেখানো হয়।
পলকের সাবেক একান্ত সচিব মুশফিকুর রহমান কামরুজ্জামানের নিয়োগের বিষয়ে বিডিসিসিএল পর্ষদকে চাপ দিতেন। ফলে গত এপ্রিলে চাকরি পান কামরুজ্জামান। চাকরি পেয়ে পূর্বের থেকেও ভয়ংকর হন কামরুজ্জামান। বিডিসিসিএলের এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, কামরুজ্জামান বলতেন মন্ত্রী মোজাম্মেল হক তার কাছের মানুষ। তার কিছু হলে পলককে দেখে নেবে মোজাম্মেল হক। তার এমন সব কথায় বেশ অস্বস্তিতে থাকতাম।
বিডিসিসিএল এর এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বার্তা৭কে বলেন, কামরুজ্জামান দম্ভ নিয়ে বলতো যে, মন্ত্রী মোজাম্মেল হক তার কাছের মানুষ। তার কিছু হলে মোজাম্মেল হক দেখে নিবে। তার এমন সব কথায় বেশ অস্বস্তিতে থাকতাম। বিডিসিসিএলের অনেক কর্মকর্তাই পারতপক্ষে তার সাথে মিশত না।
গত মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও বিতর্কিত ভূমিকা ছিল কামরুজ্জামানের। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সক্রিয় সদস্য হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার ফেসবুক প্রোফাইলে আন্দোলনের বিপক্ষে বিভিন্ন সময় পোস্ট করেছিলেন বলে একাধিক ব্যক্তি বার্তা৭ কে নিশ্চিত করেছে।
অতিচালাক কামরুজ্জামান সরকার পতনের পর সেগুলো মুছে ফেলে নিজেকে এখন বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তা হিসেবে দাবি করছেন বলেও জানা যায়।
গত ২২ আগস্ট বিসিসি এবং বিডিসিসিএল এর ৬ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয় আইসিটি বিভাগ। বিভাগের উপ-সচিব জিল্লুর রহমান স্বাক্ষরিত ঐ আদেশে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় এবং অভিযোগ তদন্তাধীন থাকায় এই আদেশ দেওয়া হয়। তবে এই তালিকায় প্রথমে মোট ৭ জন কর্মকর্তা ছিলেন। প্রথম আদেশের ৬ নম্বরে ছিলেন কামরুজ্জামান। পরবর্তীতে কামরুজ্জামানকে বাদ দিয়ে ৬ জনের বিষয়ে আদেশ জারি করে আইসিটি বিভাগ।
তবে ‘ক্ল্যারিকাল এরর’ বা করণিক ত্রুটিতে কামরুজ্জামানের নাম তালিকায় ছিল বলে দাবি করেছেন জিল্লুর রহমান।
যদিও বিডিসিসিএলের একটি সূত্র বলছে, এমডি আতাউর রহমানকে ম্যানেজ করে তালিকা থেকে নিজের নাম সরিয়েছেন কামরুজ্জামান। এমনকি পরিবর্তিত তালিকা সম্বলিত ফাইল ইনিশিয়েটও করেছেন তিনি।
গত ২০ আগস্ট বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান জনবল নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আইসিটি বিভাগের সচিব সামসুল আরেফিন বরাবর একটি চিঠি দেন। ঐ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং জিআরএস সিস্টেম সহ ই-মেইলে অভিযোগ পান এমডি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে কামরুজ্জামানের নিয়োগের অনিয়মও উঠে আসে। তবে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার সর্বশেষ আদেশেও অধরাই থাকেন কামরুজ্জামান। তবে তদন্তসাপেক্ষে যে কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে এবং এটি চলমান প্রক্রিয়া বলে যুগান্তরকে জানান আইসিটি বিভাগের উপসচিব জিল্লুর রহমান।
আইসিটি বিভাগের একটি সূত্র বলছে, কামরুজ্জামানের নিয়োগ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আসার আশঙ্কা থেকেই দায়িত্ব পালনে বিরত রাখা কর্মকর্তাদের তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে জানতে একাধিকবার কামরুজ্জামানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।