দেশের বিদ্যুৎ খাতে বিশেষ আইনের আওতায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা শতাধিক চুক্তি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এসব চুক্তির বেশিরভাগই হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা দেড় দশক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিজের হাতে রেখেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশাল প্রকল্পগুলোর টেকনিক্যাল দিকগুলো বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ঠিক করলেও, মূল সিদ্ধান্ত আসত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। আদানি, রামপাল ও মাতারবাড়ীর মতো প্রকল্পে জনগণের মতামত নেয়া হয়নি। এসব প্রকল্পের চুক্তি নিয়ে দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে।
বিএনপির অভিযোগ এবং প্রতিশ্রুতি
বিএনপি দাবি করেছে, বিদ্যুৎ খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় নিজের অধীনে রাখার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল দুর্নীতি।”
বিএনপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ সরকারের করা বিদ্যুৎ খাতের সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ ও রিভিউ করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যুৎ খাতের মতো কারিগরি মন্ত্রণালয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ নেতৃত্ব প্রয়োজন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, “বিদ্যুৎ খাত পরিচালনায় অভিজ্ঞ নেতৃত্ব প্রয়োজন। সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।”
অন্যদিকে, বিএনপির বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, “বিদ্যুৎ খাতে দক্ষতা নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জরুরি। আমাদের সরকার আসলে এসব চুক্তি জনগণের সামনে প্রকাশ করা হবে।”
চুক্তি বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগ
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পছন্দের আমলারা চুক্তি বাস্তবায়নে কমিশন বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। চুক্তির ফাইল বারবার সংশোধন করা হতো সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে।
প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকায়, তিনি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নসরুল হামিদ ও মোহাম্মদ এনামুল হককে রেখেছিলেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমদ কায়কাউস ও আবুল কালাম আজাদ পরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হন। তাদের বিরুদ্ধে প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেশী দেশের চিত্র
প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর আওতায় না রেখে আলাদা মন্ত্রীদের দায়িত্বে থাকে। ভারতের বিদ্যুৎমন্ত্রী মনোহর লাল, নেপালের দিপক খডকা ও পাকিস্তানের আওয়াইস আহমেদ খান লেঘারি নিজ নিজ মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছেন।
আগামীর পথচিত্র
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ খাত পরিচালনায় অভিজ্ঞ ও দক্ষ নেতৃত্ব প্রয়োজন। স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে এ খাতে উন্নতি হবে এবং ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাবে। বিএনপি দাবি করেছে, তাদের সরকার এ খাতে দক্ষ ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব আনবে।বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি রোধ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতে এ মন্ত্রণালয় নিয়ে নীতি প্রণয়ন জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।