তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। সেদিনই দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে যান দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিরা গা ঢাকা দেন। কেউ কেউ আশ্রয় নেন সেনা হেফাজতে। সম্প্রতি বিগত সরকারের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকদের কয়েকজন গ্রেফতার হলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কি সেনা হেফাজতে নাকি আত্মগোপনে রয়েছেন, সে বিষয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির আগে-পরে দলটির বেশকিছু দায়িত্বশীল নেতা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যান। এর মধ্যে একটি অংশ ভারতে অবস্থান করছেন। আবার কেউ কেউ সিঙ্গাপুর, কানাডাসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তবে ভারতে অবস্থানরত একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভারতে বা অন্য কোনো দেশে যেতে পারেননি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম প্রভাবশালীদের একজন ছিলেন ওবায়দুল কাদের। হয়েছেন টানা তিন মেয়াদে দলটির সাধারণ সম্পাদক। সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের মতো দপ্তরও সামলেছেন তিনি। তবে বিভিন্ন সময়ে তার নানা মন্তব্য বিরোধীদের পাশাপাশি নিজ দলের কর্মী ও জনসাধারণের মধ্যে বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এসব কারণে নিজ দলের নেতাকর্মীদের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সেনা হেফাজতে নেয়াসংক্রান্ত বিষয়ে ১৩ আগস্ট রাজশাহী সেনানিবাসে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা। জবাবে তিনি বলেন, ‘কারো যদি জীবন বিপন্ন হয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, অবশ্যই আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তাদের প্রতি যদি কোনো অভিযোগ থাকে, মামলা হয়, অবশ্যই তারা শাস্তির আওতায় যাবেন। কিন্তু অবশ্যই আমরা চাইব না যে বিচারবহির্ভূত কোনো কাজ হোক, হামলা হোক। তাদের জীবনের যে হুমকি আছে, সেটার জন্য আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। যে দলেরই হোক, যে মতেরই হোক, যে ধর্মের হোক, সেটা আমরা করব।’
এ নিয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) ১৮ আগস্ট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রাণ রক্ষার্থে রাজনৈতিক নেতা, বিচারক, পুলিশ সদস্যসহ মোট ৬২৬ নাগরিক বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় নেন। এর মধ্যে ৬১৫ জন স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ছাড়েন। চারজনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। সাতজন সেনানিবাসে অবস্থান করছেন। সেখানে ওবায়দুল কাদের কিংবা অন্য কে কে আশ্রয় নিয়েছেন, সেটি সেনা সদর স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।
আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেককে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার হতে দেখা গেছে। তবে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি। ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান সম্পর্কে জানতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি সরকার পতনের পর নির্দেশনার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হন বলে জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক বার্তা৭কে বলেন, ‘সরকার পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম ধসে পড়েছে। দলীয় প্রধানের সঙ্গে আমরা এখনো যোগাযোগ করতে পারিনি। এমনকি কাদের ভাইয়ের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। উনি কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন বা তার শারীরিক অবস্থা কেমন, সে বিষয়ে কোনো কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। আমাদের নেতাকর্মীরা পরিবর্তিত পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে সে বিষয়ে দলের বার্তা চাইছেন। আমরা সেটাও দিতে পারিনি।’
সেনা হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা আগেই দাবি করেছি, সেনা হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত। আর তাদেরকে কেন ছেড়ে দেয়া হলো, তারও একটি ব্যাখ্যা দেয়া দরকার। যারা অপরাধ করেছে, তারা দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ করেছে। সম্ভাব্য আসামিদের হেফাজতে রেখে ছেড়ে দেয়া, এটার একটা প্রতিবেদন করা দরকার।’
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাজনীতিতে আসেন ছাত্র রাজনীতির মধ্যদিয়ে। আর জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সেবার তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০০০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০০২ সালে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ পদে ছিলেন তিনি। এ পদে থাকাকালে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ মার্চ তিনি গ্রেফতার হন। ১৭ মাস ২৬ দিন কারাগারে ছিলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি।
২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নোয়াখালী-৫ আসন থেকে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে চতুর্থ ও পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। তার আগে দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে ২১তম এবং ২০২২ সালে ২২তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি টানা তিন মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সাধারণ সম্পাদকের পদে যাওয়ার পর রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরি করেন ওবায়দুল কাদের। ব্যক্তিগত অনেক সিদ্ধান্ত দলের সিদ্ধান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দলের দায়িত্বশীল নেতারা এবং এমপি-মন্ত্রীদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করতেন বলেও শোনা যায়।