এক দশকের কাছাকাছি সময় ধরে বলতে গেলে মিত্র রাশিয়ার শক্তিতেই ক্ষমতায় টিকে ছিলেন সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। তবে সেটি গত একদিন আগের অভাবনীয় পরিবর্তন পর্যন্ত।
বিদ্রোহীদের হাতে রাজধানী দামেস্কের পতন, বাশারের দেশ ছেড়ে পালিয়ে মস্কোতে আশ্রয় নেওয়া- রোববার ভোর থেকে দুপুরের আগেই রীতিমত ভোজবাজির মতো ঘটে গেছে।
ক্রেমলিনের একটি সূত্রের বরাতে রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা এবং টেলিভিশনগুলো জানিয়েছে বাশার আল-আসাদ ও তার পরিবারকে ‘মানবিক কারণে’ আশ্রয় দিয়েছে দীর্ঘদিনের মিত্র দেশটি।
মাত্র কয়েকদিন, দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ক্রেমলিনের সিরিয়া ‘প্রজেক্ট’ মুখ থুবড়ে পড়ায় প্রকাশ হলো, মস্কো তার মিত্রকে রক্ষা করতে সক্ষম নয়।
‘সিরিয়ায় নাটকীয় ঘটনার পর মস্কো গভীর উদ্বেগ নিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে’ এমন বিবৃতি দিয়ে আপাতত দায় সেরেছে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বাশার আল-আসাদের পতন যে মস্কোর জন্য বড় ধরনের একটি আঘাত হয়ে এসেছে, তা পরিষ্কার।
২০১৫ সালে বাশারের সমর্থনে হাজার হাজার সেনা সিরিয়ায় পাঠায় রাশিয়া, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নিজেদেরকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে জাহির করা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর পশ্চিমা ক্ষমতা ও আধিপত্যকে সেবারই প্রথম বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন।
সে সময় তার এই উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
২০১৭ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সিরিয়ার হামাইমিম বিমান ঘাঁটি পরিদর্শনে গিয়ে মিশন সফল হওয়ার ঘোষণা দেন।

২০১৭ সালে সিরিয়ার হামাইমিম বিমান ঘাঁটি পরিদর্শনে গিয়ে সেনাদের কুচকাওয়াজ দেখেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রুশ বিমান হামলায় প্রতিনিয়ত বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুর খবর এলেও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে সেখানে অভিযান প্রত্যক্ষ করতে দেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিল রাশিয়ার।
এমনই একটি অভিযান কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন বিবিসি রাশিয়ার সম্পাদক স্টিভ রোজেনবার্গ।
“আমার মনে আছে, সে সময় একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, সিরিয়ায় রাশিয়ার যাত্রাটা অনেক দীর্ঘ হবে,” বলেন তিনি।
কিন্তু বিষয়টি রাশিয়ার সম্মানের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল।
সামরিক সহায়তার বিনিময়ে সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ হামেইমিম বিমান ঘাঁটি এবং টারটোস নৌঘাঁটি ৪৯ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিল রাশিয়াকে।
এর মাধ্যমে রাশিয়া পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে।
রাশিয়ার এই দুটি ঘাঁটি আফ্রিকা এবং আফ্রিকার বাইরের সামরিক ঠিকাদারদের গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যে পরিণত হয়।
এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটিগুলোর কী হবে?
বাশারের মস্কো পৌঁছানোর বিবৃতিতেই মস্কো জানিয়েছে, রাশিয়ার কর্মকর্তারা সিরিয়ার সশস্ত্র বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
ওদিকে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দাবি করা হয়েছে, বিরোধী দলের নেতারা রাশিয়ার ঘাঁটি এবং কূটনৈতিক মিশনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বলেছে, সিরিয়ার ঘাঁটিগুলোতে ‘সর্বোচ্চ সতর্কতা’ জারি করা হলেও ‘বর্তমানে নিরাপত্তাজনিত বড় কোনো হুমকি নেই’।
বাশার আল-আসাদ ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কট্টর মিত্র। ক্রেমলিনও দীর্ঘদিন তার জন্য প্রচুর ব্যয় করেছে।

সিরিয়ার টারটোসে রাশিয়ার বিমানবাহী রণতরী ‘কুজনেতসভ’র এর সামনে নৌসেনাদের অবস্থান। ছবি: রয়টার্স
এখন বাশারের পতন যে কোনো ধাক্কা নয়, বরং পেছনে অন্য কিছু ছিল, সেটি প্রমাণের জন্য রুশ কর্তৃপক্ষকে রীতিমত লড়াই করতে হবে। ‘বলির পাঁঠা’ কাকে বানানো যায়, সেই চেষ্টাই তারা করছে।
রোববার রাতেই তার প্রমাণ দেখা গেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের একটি সাপ্তাহিক সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠানে, যেখানে সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করে বলা হয়, তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টাই করেনি।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ইয়েভগেনি কিসেলেভ বলেন, “সবাই দেখছিল সিরিয়ার কর্তৃপক্ষের জন্য ঘটনা ক্রমেই নাটকীয় হয়ে উঠছিল। কিন্তু উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আলেপ্পোতে কার্যত কোনো লড়াই ছাড়াই (সেনা) অবস্থান ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। (সরকারি বাহিনী) যথেষ্ট সুসজ্জিত এবং হামলাকারীদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি থাকলেও সুরক্ষিত এলাকাগুলোতে একের পর এক আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে এবং পরে সেসব অবস্থান উড়িয়ে দেওয়া হয়। এটি একটি রহস্য!”
ওই উপস্থাপক দাবি করেন, “রাশিয়া সিরিয়ায় সব সময়ই (সব পক্ষের মধ্যে) সমঝোতার বিষয়ে আশাবাদী ছিল।”
তারপরও চূড়ান্ত বিষয়টি কী?
“সিরিয়ায় যা ঘটছে তা নিয়ে আমরা অবশ্যই উদাসীন নই। কিন্তু রাশিয়ার নিজস্ব নিরাপত্তাই আমাদের অগ্রাধিকার, যা বিশেষ সামরিক অভিযানের এলাকায় (ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ) চলছে।”
রাশিয়ার জনগণের জন্য এই বার্তাটির মধ্যেই রয়েছে পরিষ্কার ইঙ্গিত।
নয় বছর ধরে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে রাশিয়া ব্যাপক বিনিয়োগ করলেও, চিন্তিত হওয়ার হওয়ার মতো যে আরো বিষয় রয়েছে, সেটিই রুশ জনগণকে বলে দেওয়া হয়েছে।